রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নষ্ট হচ্ছে কলকাতার ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন কলেজের ইতিহাস

অনুভব খাসনবীশ, কলকাতা: হিন্দু কলেজ, বেথুন কলেজ, শ্রীরামপুর কলেজ কিংবা সিটি কলেজ। পশ্চিমবঙ্গ বা কলকাতার পুরনো কলেজ বললে একধাক্কায় মাথায় আসে এই নামগুলো। কিন্তু ডাফ…

kolkata Duff College

অনুভব খাসনবীশ, কলকাতা: হিন্দু কলেজ, বেথুন কলেজ, শ্রীরামপুর কলেজ কিংবা সিটি কলেজ। পশ্চিমবঙ্গ বা কলকাতার পুরনো কলেজ বললে একধাক্কায় মাথায় আসে এই নামগুলো। কিন্তু ডাফ কলেজ? নামটা খানিক অচেনা হলেও কলকাতার অন্যতম পুরনো কলেজ এটি। যদিও, বর্তমানে এই ডাফ কলেজকেই আমরা চিনি অন্য নামে।

রেভারেন্ড আলেকজান্ডার ডাফ, স্কটল্যান্ড থেকে ভারতে এসেছিলেন নিছক ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে। সালটা ১৯৩০। চার্চ অফ স্কটল্যান্ডের অধীনে থেকে কয়েকমাস ধর্ম প্রচারের পর তিনি বুঝতে পারেন, এদেশে প্রয়োজন ইংরেজি শিক্ষার। তাই ধর্মপ্রচারের সঙ্গে সঙ্গে কলকাতার বুকে ইংরাজি শিক্ষার প্রসার এবং সমাজ সংস্কারে উদ্যোগী হলেন তিনি৷ ভারতবর্ষে ইংরেজি শিক্ষার অভাব দেখে সেই সময়েই রাজা রামমোহন রায় এবং তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেন্টিংয়ের সহায়তায় তিনি ৫১ নম্বর আপার চিৎপুর রোডে ফিরিঙ্গি কমল বসুর বাড়িতে দুটি ঘর ভাড়া নিয়ে ওই বছরেরই ১৩ জুলাই স্কুল খোলেন৷ নাম দেন জেনারেল এসেম্বলিজ ইনস্টিটিউশন। কিছুদিন পরে, সেখান থেকে গোঁরাচাঁদ বসাকের বাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়া হল এই স্কুল (প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এখনকার রবীন্দ্রসরণির সেই বাড়িতে রয়েছে ওরিয়েন্টাল সেমিনারি স্কুল)৷ তার ঠিক চোদ্দবছর পর প্রতিষ্ঠা করেন ‘ফ্রি চার্চ ইনস্টিটিউশন, কলকাতার নতুন একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

Reverend Alexander Duff

মথুরমোহন সেন। সেই সময়ের কলকাতায় আমদানী হওয়া বাবু কালচারের অন্যতম ধারক এবং বাহক। কলকাতার অন্যতম ধনী ব্যক্তি মথুরমোহনের নিমতলা স্ট্রিটে ছিল বিশাল বাগানবাড়ি। ঠিক তারপাশেই ছিল উমিচাঁদের বাগানবাড়ি। পাশাপাশি দুটি বাগানবাড়ি থাকায় জায়গাটির নাম হয় জোড়াবাগান। যদিও, অনেকে বাগানবাড়িটি মথুরমোহনের বদলে গোবিন্দরাম মিত্তিরের ছিল বলেও দাবি করেন।

সেই মথুরমোহনের বিল্ডিংয়েই প্রথম ক্লাস শুরু করেন আলেকজান্ডার ডাফ। তারপরে ১৮৫৭ সালের মার্চ মাসে ১৮ হাজার টাকায় জমি কেনেন ৭৪ নম্বর নিমতলা ঘাট স্ট্রিটে। তৈরি হয় ‘ডাফ কলেজ। আর্থিক অনুদান পাঠিয়েছিলেন বহু ইংরেজ। স্কটল্যান্ড থেকে বাড়িটির নকশা তৈরি করে পাঠিয়েছিলেন বিখ্যাত বাস্তকার উডকাট সাহেব৷ ‘দ্য ফ্রি চার্চ অফ স্কটল্যান্ড’ এর পক্ষ থেকে এসেছিল প্রায় ৫০ হাজার পাউন্ড। মোট ২৮টি বিশালাকার ঘরে বসার ব্যবস্থা ছিল প্রায় ১০০০ – ১২০০ ছাত্রছাত্রীর। এছাড়াও ছিল তিনটি হলঘর, দুটি গ্যালারি, লাইব্রেরি, ল্যাবরেটরি, খেলার মাঠ।

kolkata old Duff College
এই ডাফ কলেজেরই অন্যতম কৃতী ছাত্র হলেন রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, ধর্মযাজক কালীচরণ ব্যানার্জি, শেক্সপেরিয়ান স্কলার জে. সি. স্ক্রিমজেওর প্রমুখ। ১৮৪৩-৪৪ সাল নাগাদ স্কটল্যান্ডে চার্চের মধ্যে বিরোধ শুরু হলে ডাফ সাহেব ‘জেনারেল অ্যাসেম্ব্লিজ ইন্সটিটিউশন ছেড়ে বেড়িয়ে আসেন। সহযোগীদের সহায়তায় এই আধুনিক কলেজটি বানান।

এই ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায় ফ্রি চার্চ অফ স্কটল্যান্ডের মিশনারী, রেভারেন্ড লালবিহারী দে’র লেখায়। তিনি লিখেছেন, “Just one week after the close of the session of 1843, the missionaries heard that the established Church of Scotland had refused to give them the use of the buildings in Cornwallis Square. Duff was naturally incensed at this decision…as it was chiefly through his own personal exertions that the money for the buildings had been raised.”

পরে অবশ্য স্কটিশদের বিরোধ মিটে গেলে ডাফ সাহেব হেদুয়ার পাশে জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ ইনস্টিউটের বাড়িতে চলে যান। ফলে ১৯০৮ সালে হেদুয়ার পাশে চলে আসে ‘ডাফ কলেজ’। আলেকজান্ডার ডাফেরই প্রতিষ্ঠা করা ‘জেনারেল অ্যাসেম্ব্লিজ ইন্সটিটিউশনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে এর নামকরণ হয় ‘Scottish Churches College’। যা ১৯৩০ সালে ‘স্কটিশ চার্চ কলেজ’ (Scottish Church College) নামে আত্মপ্রকাশ করে।

১৯২০ সালে ওই বিল্ডিংয়ের চালু হয় জোড়াবাগান থানা। সেসময় ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলন তার চরম সীমায়। তাতে সবচেয়ে বেশি অংশগ্রহন করেছিল বাংলা এবং বাঙালিরা। কুখ্যাত ব্রিটিশ পুলিশ অফিসার চার্লস টেগার্ট ছিলেন তৎকালীন জোরাবাগান থানার প্রধান। এই ডাফ কলেজে বিল্ডিংয়ের একটি অংশেই শুরু করেছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ওপর অত্যাচার করা। ১৯৭০ সালের নকশাল আন্দোলন দমনেও তৎপর হয়ে ওঠে কলকাতা পুলিশ, আন্দোলনকারীদের নিয়ে আসা হত এই বিল্ডিংয়েই, টেগার্টের ঠিক করা অংশেই তাদের ওপর চলত অকথ্য অত্যাচার।

১৯৭১-৭২ সাল নাগাদ কালীপুজোর সময় এই থানা খবর পায়, গোপনে অস্ত্র পাচার করা হচ্ছে কলকাতায়। তল্লাশি চালিয়ে গ্রেফতার করা হয় বেশ কয়েকজনকে, বাজেয়াপ্ত করা হয় দু’বাক্স বিস্ফোরক। থানার একটি ঘরেই রাখা ছিল সেই বাক্সদুটি। ঠিকমতো না রাখায় দিনকয়েকের মধ্যেই ঘটে বিরাট বিস্ফোরন। ছিন্নভিন্ন হয়ে যান ঘরে থাকা পুলিশকর্মীরা, উড়ে যায় ঘরের ছাদ। ১৯৮৮ সালে ‘অনিরাপদ’ বলে ঘোষণা করা হয় এই বিল্ডিংকে। থানা সরে যায় পাশের একটি বিল্ডিংয়ে। বর্তমানে কলকাতা কর্পোরেশনের ‘হেরিটেজ কনজারভেশন কমিটি’র পক্ষ থেকে ‘গ্রেড ওয়ান হেরিটেজের’ তালিকায় রাখা হয়েছে ডাফ কলেজের বিল্ডিংকে।