বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহীই ছিলেন না ভারতের পরমাণু শক্তির কারিগর

Special Correspondent, Kolkata: ভারতের এত বড় বিজ্ঞানী, অথচ তা‍ঁর বিজ্ঞানে কোনও আগ্রহই ছিল না। ছোট থেকেই কবিতা লেখার আগ্রহ ছিল। পৃথিবীর বুকে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন…

homi jehangir bhabha

Special Correspondent, Kolkata: ভারতের এত বড় বিজ্ঞানী, অথচ তা‍ঁর বিজ্ঞানে কোনও আগ্রহই ছিল না। ছোট থেকেই কবিতা লেখার আগ্রহ ছিল। পৃথিবীর বুকে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন পরিবর্তনকে নিয়েই তিনি কবিতা লিখতেন। রং-তুলি নিয়ে ছবি আঁকতে ভালোবাসতেন। এছাড়াও রীতিমত উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের চর্চা করতেন প্রতিদিন। তাঁর গলায় সুরের খেলা শুনেই প্রতিবেশীরা মুগ্ধ হয়ে যেতেন।

সঙ্গীতের প্রতি ভালবাসা শৈশব থেকেই ছিল। তা আরো পরিণত হয় হোমির মাসি কুমা পান্ডের প্রভাবে। তাঁর কাছে বেঠোফেন, মোৎসার্ট, বাখ, হাইডন, শুবার্ট প্রমুখের গ্রামোফোন রেকর্ডের সংগ্রহ ছিল প্রচুর। হোমি ছোট ভাই জামশেদের সাথে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা সঙ্গীত শুনতেন। হোমির পিসি চমৎকার পিয়ানো বাজাতেন। পিসির কাছে পিয়ানো শিখেছিলেন হোমি। কিন্তু পড়াশোনার পরিমাণ ক্রমশ বেড়ে যাওয়ার কারণে অন্যসবকিছু গৌণ হয়ে পড়ে।

১৯০৯ খ্রিস্টাব্দের ৩০ অক্টোবর হোমি ভাবা একটি ঐতিহ্যশীল এবং সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। হোমির বাবা জাহাঙ্গীর হরমুসজি ভাবা অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে এম. এ. এবং লন্ডন থেকে ব্যারিস্টারি পাস করেন। টাটা শিল্পগোষ্ঠীর আইন উপদেষ্টা ছিলেন তিনি। সেই সুবাদে টাটা গ্রুপের অনেকগুলো কোম্পানির পরিচালনা পরিষদেও ছিলেন তিনি। পাশ্চাত্য সঙ্গীত ও চিত্রকলার প্রতি গভীর অনুরাগ ছিল জাহাঙ্গীর ভাবার। হোমির পিতামহ ডক্টর কর্নেল হরমুসজি ভাবাও লন্ডন থেকে এম. এ. ও ডি. লিট. প্রাপ্ত। মহীশুর রাজ্যের শিক্ষাবিভাগের ইন্সপেক্টর জেনারেল ছিলেন তিনি। শিক্ষার উন্নয়নে তাঁর অবদানের জন্য ব্রিটিশ সরকার তাঁকে বিশেষ সম্মান প্রদান করেন। হোমির মা মেহেরবাঈ ফ্রামজি পান্ডে ছিলেন ভিকাজি ফ্রামজি পান্ডের কন্যা এবং বিখ্যাত সমাজসেবী, ব্রিটিশ ভারতের প্রথম ব্যারোনেট স্যার দিনশ পেটিটের নাতনি। টাটা শিল্পগোষ্ঠীর সাথে পারিবারিকভাবে আত্মীয়তা ছিল হোমির পরিবারের। হোমির পিসির সাথে বিয়ে হয়েছিল টাটা গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা জামশেদ টাটার বড় ছেলে স্যার দোরাব টাটার।

homi jehangir bhabha

তবে তাঁর বাবা আইনজীবী হলেও বিজ্ঞানের প্রতি ভালই ঝোঁক ছিল। বাড়িতে বিজ্ঞানের অনেক বই দিয়ে একটা লাইব্রেরী তৈরি করেছিলেন। স্কুলের পড়া শেষ করে ভাবা ভাবতে শুরু করলেন, বিজ্ঞান আমার কোথায় কাজে লাগলো? তখন তাঁর বাবা তাঁকে পাঠিয়ে দিলেন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে। যদিও খুব বেশি দিন তিনি এই নিরস জগতে কলকব্জা নাড়াচাড়া করে কাটাতে পারলেন না। চলে এলেন পদার্থবিদ্যার ছায়াতলে।

এই পদার্থবিদ্যা তাঁকে পুরোপুরি পরিবর্তন করে দিল। তাঁর মনে হয়েছিল, আর সাহিত্য, আঁকা বা সঙ্গীত নয়, পদার্থবিদ্যার মধ্যেই লুকিয়ে আছে তাঁর আসল অভীষ্ট। উল্লেখযোগ্য পদার্থবিদ ডিরাকের মতবাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন এবং ঘন্টার পর ঘন্টা তাঁর বিভিন্ন বই পড়ে সময় কাটিয়ে দিতেন। ১৯৩৪ সালে তিনি পদার্থবিদ্যায় ডিগ্রি অর্জন করলেন।

ছোটো বেলায় তাঁর ঘুম খুব কম হতো, এই নিয়ে তাঁর বাবা মা খুব চিন্তিত ছিলেন। ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে ডাক্তার তাঁদেরকে বলেন যে, এই নিয়া চিন্তার কোনো কারণ নেই, তাঁদের ছেলে জন্মেছে একটি অতি সক্রিয় মস্তিষ্ক নিয়ে, যা “সুপার অ্যাক্টিভ ব্রেন” নামে পরিচিত। যার ভিতর অনবরত চিন্তার স্রোত প্রবাহিত হয়।

১৯৩৬ সালে কোপেনহাগেন বোর ইনস্টিটিউটে ডব্লিউ নাইট বোরের সহযোগিতায় ‘ক্যাসকেড থিওরি অব কসমিক রে শাওয়ার’ নামে নতুন একটি বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব আবিষ্কার করেন। এ তত্ত্ব আবিষ্কারের ফলেই গোটা ইউরোপে পরিচিতি পেয়ে যান ভাবা। আবিষ্কারের স্বীকৃতিস্বরূপ পরের বছর জিতে নেন অ্যাডামস পুরস্কার। ১৯৪১ সালে ইংল্যান্ডে রয়্যাল সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত হন ভারতীয় এই পরমাণুবিজ্ঞানী। ১৯৪৫ সালে মূলত তাঁর প্রচেষ্টায়ই মুম্বইয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘টাটা ইনস্টিটিউট অব ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ’ নামের একটি পরমাণু গবেষণা কেন্দ্র।

লন্ডনে পড়াশোনা চলাকালীন তিনি নিউটন স্টুডেন্টশীপ পান। সেখানে তাঁর থিসিস জমা দেওয়ার পর তাকে পিএইচডি উপাধি দেওয়া হয়। সেই সাথে “১৮৫১ এক্সিবিশন স্টুডেন্টশিপ” বৃত্তি দেওয়া হয়। পান ‘রাউজ বল ট্রাভেলিং স্টুডেন্টশীপ’। ১৯৫৪ তে তিনি পদ্মভূষণ এ সম্মানিত হন। কোপেনহেগেনে থাকা কালীন তিনি ড.ডাব্লিউ হাইটলার এর সহযোগিতায় তিনি “Cascade Theory Of Cosmic Ray Shower” তত্ত্ব আবিষ্কার করেন যা ছিল তাঁর বৈজ্ঞানিক প্রতিভার প্রথম স্ফুরণ।

তিনি একাধারে ছিলেন একজন বিজ্ঞানী, সংগঠক, চিত্র শিল্পী, সুনির্মল গানের শ্রোতা। জীবন সঙ্গী হিসেবে বিজ্ঞানকেই বেছে নিয়েছিলেন তিনি। একদিন এক সহপাঠীকে ডিটেকটিভ বই পড়তে দেখে বলেছিলেন, “বিজ্ঞানের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ডিটেকটিভ বই আর কি হতে পারে।”

ভারতের একজন প্রসিদ্ধ নিউক্লীয় পদার্থবিজ্ঞানী, প্রতিষ্ঠাকালীন ব্যবস্থাপক এবং টাটা মৌলিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান এর পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক ছিলেন জাহাঙ্গীর। তাছাড়া তাঁকে ‘ভারতের নিউক্লীয় প্রোগ্রামের জনক’ বলা হয়। তিনি ভারতের দুটি প্রসিদ্ধ শিক্ষা তথা গবেষণা প্রতিষ্ঠান টাটা মৌলিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান (TIFR) এবং ট্রম্বে এটমিক এনার্জি (AEET) প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাকালীন ব্যবস্থাপক ছিলেন(যা বর্তমানে তাঁর নামে নামকরণ করা হয়েছে); উভয় প্রতিষ্ঠানই নিউক্লিয়ার অস্ত্রে ভারতের অগ্রগতিতে ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। যেখানে জাহাঙ্গীর স্বয়ং তত্ত্বাবধায়করূপে ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব পালন করতেন।

বয়স ত্রিশ হবার আগেই হোমি ভাবা নিজের যোগ্যতায় বিশ্ববিজ্ঞানীদের সভায় আসন করে নিয়েছেন। তখন কেমব্রিজে বিশ্বসেরা পদার্থবিজ্ঞানীদের অনেকেই কাজ করছিলেন। রাশিয়ান পদার্থবিজ্ঞানী পিত্রর কাপিৎজা সেই সময় লর্ড রাদারফোর্ডের ছাত্র ছিলেন। প্রতি মঙ্গলবার সন্ধ্যায় কাপিৎজা’র রুমে বৈজ্ঞানিক সভা অনুষ্ঠিত হতো। অত্যন্ত উঁচুমানের বৈজ্ঞানিক প্রতিভা ছাড়া ওই সভায় যোগ দেয়া কারো পক্ষে সম্ভব ছিল না। অনেক বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের প্রথম ঘোষণা দেয়া হয়েছিল ‘কাপিৎজা ক্লাব’ নামে পরিচিত ছিল ঐ বিজ্ঞান-সভায়। ১৯৩৮ সালের শুরুতে কাপিৎজা ক্লাবে বক্তৃতা দেন হোমি ভাবা। কাপিৎজা ক্লাবে হোমি ভাবা যাঁদের সংস্পর্শে এসেছিলেন পরবর্তীতে তাঁদের প্রত্যেকেই পৃথিবীবিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন, অনেকেই পেয়েছেন ‘নোবেল পুরষ্কার’।

ভারতে পরমাণু গবেষণার জনক ছিলেন বিজ্ঞানী ভাবা। কিছু দিন পরই ভারত সরকারের পক্ষ থেকে তাঁকে একটি পারমাণবিক শক্তি উৎপাদন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব নিতে অনুরোধ করা হয়। সঙ্গে সঙ্গেই তিনি রাজি হয়ে যান। এ ছাড়াও ভারতে থোরিয়াম প্ল্যান্ট, ইউরেনিয়াম প্ল্যান্ট, ফুয়েল এলিমেন্ট ফেব্রিকেশন ফ্যাসিলিটি, হেভিওয়াটার প্ল্যান্ট ইত্যাদি প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তিনি। তিনি যখন পরমাণু অস্ত্র নিয়ে বক্তৃতা দিতেন, তখন তাঁর কথা শুনে মনেই হতো না যে, পরমাণু অস্ত্র দিয়ে কারুর ক্ষতি করা সম্ভব। এতটাই ভালো মানুষ ছিলেন তিনি।

যদিও এই পরমাণু অস্ত্র নিয়ে কাজকর্ম তাঁর প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল, এমনটা বলাই যায়। তিনি মারা যান এক বিমান দুর্ঘটনায়। যদিও সেটা দুর্ঘটনা নাকি ষড়যন্ত্র, সেই নিয়ে প্রচুর মতবাদ আছে।